Wednesday, December 14, 2011

যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল থেকে সুবিচার পাওয়ার সুযোগ নেই : ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক

বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া এবং ট্রাইবুনালের বিচারপতির প্রতি অভিযুক্তদের অনাস্থা এবং যুদ্ধাপরাধ সম্পর্কিত’ আইনের নানা দিক নিয়ে আমরা কথা বলেছি, বাংলাদেশের বিশিষ্ট আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের সাথে।
পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকারটি এখানে উপস্থাপন করা হল

রেডিও তেহরান : যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল নিয়ে এমনকি গোটা বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে ইতিমধ্যে অনেকেই কথা বলছেন। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তো আমরা জানতে চাচ্ছি, কেন এবং সুনির্দিষ্ট কোন কোন বিষয়ের কারণে ট্রাইবুনাল এবং বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে?

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক :দেখুন, যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে কয়েকটি কারণে প্রশ্ন উঠেছে।
প্রথমত : বলা যায়, যে আইনের মাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়া অনুষ্ঠিত হচ্ছে সেই আইন আন্তর্জাতিক মানের অনেক নীচে। শুধু আন্তর্জাতিক মানের অনেক নীচেই না ; বাংলাদেশে যেসব আইন রয়েছে বা আন্তর্জাতিক যেসব আইনে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে সেসব আইনেরও অনেকে নীচে এই আইন।
দ্বিতীয়ত: হচ্ছে বাংলাদেশে বহুবিধ আইন আছে, যেমন- বাংলাদেশের সংবিধান আছে, এছাড়া বাংলাদেশের সাক্ষ্য আইন আছে,ফৌজদারী কার্যবিধি আছে। এসব আইন আমাদের দেশের আইন। এই আইনগুলোও এখানে প্রযোজ্য নয়। সুতরাং এই যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনালে; না আন্তর্জাতিক আইন না দেশীয় আইন; কোনটাই প্রযোজ্য নয়। ফলে এই ট্রাইবুনালে সুবিচার পাওয়া যাবে না ; এখানে বিচারের নামে অবিচার হবে।
এছাড়া এই ট্রাইবুনালে যে তিনজনকে বিচারক হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে, তার মধ্যে যিনি ট্রাইবুনালের প্রধান হিসেবে আছেন,অর্থাৎ বিচারপতি নিজামুল হক- তিনি এ বিষয়ে যখন ইনভেস্টিগেট হয় তখন তার সংগে জড়িত ছিলেন। সুতরাং একজন ব্যক্তি যিনি ইনভেস্টিগেটর ছিলেন তিনি জাজ বা বিচারক হতে পারেন না। আর এ বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতেও এই আইন স্বীকৃত । ফলে একজন ইনভেস্টিগেটর যেখানে বিচারক এবং ট্রাইবুনালের প্রধান হিসেবে কাজ করেন সেখানে এই ট্রাইবুনালের কাছে তো কোন বিচার পাওয়া যাবে না।
যদি এখানে বিচার নিশ্চিত করতে হয় তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। আমি আগেও এ সম্পর্কে বলেছি যে, ৫ টি মহাদেশ থেকে ১৫ জন বিচারক আনা হোক, ট্রাইবুনালের আইনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করা হোক, আইনকে জনসমক্ষে উন্মুক্ত করা হোক,সরকার পক্ষ ও অভিযুক্ত পক্ষ উভয়ের জন্য বিদেশী আইনজীবী আনার সুযোগ দেয়া হোক। যদি এসব করা হয় তাহলে বিচার হতে পারে । তা নাহলে এখানে বিচার হবে না। সুবিচার পাবে না অভিযুক্তরা।

রেডিও তেহরান : আচ্ছা ট্রাইবুনালের বিচারপতি নিজামুল হকের প্রতি মাওলানা সাঈদী যে অনাস্থা জ্ঞাপন করেছেন, তা দুই বারই আদালতে খারিজ হয়ে গেছে। আসলে আইনে কি আছে? একজন যদি কোন বিচারকের উপর অনাস্থার কথা বলে, তাহলে বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সে ক্ষেত্রে বিচার বিভাগ বা সরকার কি পদক্ষেপ নিতে পারে ।

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক : দেখুন, এটি খুবই দু:খজনক বিষয়। বাংলাদেশের বিচার বিভাগ কিন্তু নতুন সৃষ্টি হয়নি। এখানে ১৮৬২ সালে হাইকোর্ট ও সুপ্রীমকোর্ট হয়েছে। এটি দীর্ঘদিনের ইতিহাস। আর তখন থেকেই একটি নিয়ম চলে আসছে যে, কোন একজন বিচারপতিকে বিশেষ করে হাইকোর্টের বিচারপতিকে নিয়ে যদি কেউ প্রশ্ন তোলে যে আপনি একজন আইনজীবী হিসেবে ছিলেন এই বিচার কার্যে বা কোন কারণে অনাস্থা আনা হয় তাহলে সাথে সাথে তিনি বা সেই বিচারপতি বিচার কাজ থেকে নিজেকে উইদড্রো করে নেন। মামলাটি সাথে সাথে অন্য বিচারকের কাছে পাঠিয়ে দেন। ট্রাইবুনালের বিচারপতি নিজামুল হক নাসিম; তিনিও হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, তিনিও বিষয়টি জানেন। এটি কিন্তু একটি অত্যন্ত সাধারণ বিষয় যা আমাদের আদালত প্রাঙ্গণে হয়ে থাকে। আমাদের হাইকোর্ট সুপ্রীম কোর্টের বারান্দায় যারা ঘোরাফেরা করে তারাও এ বিষয়টি জানে। তারপরও একজন অভিযুক্ত যখন নিজামুল হকের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনলেন তারপরও তিনি সেখানেই আছেন। তবে এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে তার ব্যাপারে প্রশ্ন তোলা বা অনাস্থাজ্ঞাপনের পর তিনি আর এই বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারেন না। হি ইজ সিমপলি ডিসকোয়ালিফাইড।

রেডিও তেহরান : এসব কিছুর পর এই ট্রাইবুনাল যদি মাওলানা সাঈদীকে শাস্তি দেয় তাহলে আইনের দৃষ্টিতে তা কতখানী গ্রহণযোগ্য হবে?

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক : দেখুন আপনি যে প্রশ্নটি করলেন, যে মাওলানা সাঈদীর অনাস্থা সম্পর্কিত আবেদন বা বিচারপতির বৈধতা নিয়ে করা আবেদন খারিজ করার পরও যদি এই ট্রাইবুনাল মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে শাস্তি দেয় তাহলে তা আইনের দৃষ্টিতে কি হবে ? এ প্রসঙ্গে আমি বলব সেই রায় মোটেও গ্রহণযোগ্য হবে না । দেশীয় আইনেও গ্রহণ যোগ্য হবে না, আন্তর্জাতিক আইনেও গ্রহণযোগ্য হবে না।

রেডিও তেহরান: আচ্ছা বর্তমানে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল থেকে যে রায় হবে তার বিরুদ্ধে কি উচ্চ আদালতে আপিল করার সুযোগ আছে কি না ?

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক : আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে প্রশ্ন করেছেন। সাধারণত আদালতের কোন একটি রায়ের পর উচ্চ আদালতে আপিলের সুযোগ থাকে। কিন্তু যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুনাল থেকে রায়ের পর তার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করার কোনো সুযোগ আমাদের নেই। আর এ সুযোগ না থাকার কারণে এই আইনটিকে কালো আইন হিসেবে অভিহিত করছি ।
দেখুন কোন বিচারের ক্ষেত্রে যেটি হয়ে থাকে-সেটি হচ্ছে সব বিচার কাজ যখন শেষ হয়ে যায় যখন শাস্তি ঘোষণা করা হয় তখন ফাইনালি একবার সুপ্রীমকোর্টে যাওয়ার সুযোগ থাকে। কিন্তু এখানে সে সুযোগ নেই। ফলে এটি একটি কালো আইন।

রেডিও তেহরান : আচ্ছা গোটা যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া এবং ট্রাইবুনালের কার্যক্রমকে আপনি কিভাবে দেখছেন ?

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক :গোটা যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া এবং ট্রাইবুনালের কার্যক্রম নিয়ে আমি বলব, এখানে আমরা বিচার পাব না, সুবিচার পেতে পারি না। তবে আমরা একটা জিনিষিই চাই যে সুবিচার হোক, সুবিচার হোক এবং সুবিচার হোক।


রেডিও তেহরান : বিএনপির সংসদ সদস্য সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী বলেছেন, সংবিধান লংঘন করে এই ট্রাইবুনাল গঠন করা হয়েছে। এছাড়া এই ট্রাইবুনাল নিজেও আইন মানছে না। আপনি একজন বিশিষ্ট আইনজীবী হিসেবে সালাহ উদ্দীন কাদের চৌধুরীর এই বক্তব্যকে কিভাবে দেখছেন?

ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক : সালাহউদ্দীন কাদের চৌধুরী যে কথা বলেছেন সেটি একটি বিষয়। আমাদের কথা হচ্ছে সংবিধান অনুযায়ী এই বিচার হচ্ছে না ।মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের ক্ষমতা কারো নেই।দেশের যে কোন ব্যক্তিকে যদি বিচারের কাঠগড়ায় নেয়া হয় এবং তার যদি সেখানে মৌলিক অধিকার ক্ষুন্ন হয় তাহলে সে হাইকোর্টে বা সুপ্রীম কোর্টে যেতে পারে । কিন্তু এই ট্রাইবুনালে সেরকম কোনো সুবিধা কারো নেই।

No comments:

Post a Comment